তিন দফা সময়-ব্যয় বাড়িয়েও শেষ হয়নি ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ ইউনিট আধুনিকায়নের কাজ। তিন বছরের প্রকল্প গিয়ে ঠেকেছে সাড়ে ৯ বছরে। বিশ্বব্যাংক সাধারণত কাজের ওপর ভিত্তি করেই ঋণছাড় করে। এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রকল্প শেষ না করায় বাকি ২৬১ কোটি টাকা ঋণছাড় করবে না সংস্থাটি।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বাবিউবো) সূত্র জানায়, মূল প্রকল্প অনুমোদনের সময় প্রকল্পটির অনুকূলে বিশ্বব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৭ কোটি ডলার। পরবর্তীসময়ে প্রকল্প ঋণের পরিমাণ ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কমিয়ে ২০ দশমিক ৭ কোটি মার্কিন ডলার নির্ধারিত হয়। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তির মেয়াদ ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছে। ফলে প্রকল্পটি ধীরগতিতে বাস্তবায়নের কারণে সংস্থাটির ২ দশমিক ১৯ কোটি ডলার ব্যবহার করা যাচ্ছে না। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় এই অর্থ দেবে না সংস্থাটি। প্রতি ডলার সমান ১১৯ টাকা ৩২ পয়সা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংক টাকা না দেওয়ার কারণে এখন সরকারি কোষাগার থেকে এই চাহিদা মেটানো হবে। যে কারণে চতুর্থবারের মতো সংশোধন হচ্ছে প্রকল্পটি।
এ প্রসঙ্গে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ ইউনিট আধুনিকায়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুল বাছিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল নাগাদ ও ব্যয় ৫৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বাড়বে।’
নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ করে কেন বিশ্বব্যাংকের পুরো ঋণ ব্যবহার করা গেলো না? এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে প্রকল্পের পরিচালক বলেন, ‘আমি এর বাইরে আর কিছু বলতে পারবো না। সেই এখতিয়ারও আমার নেই।’
বিশ্বব্যাংকের ঋণ হাতছাড়া হওয়ার জন্য প্রকল্পে সঠিক শৃঙ্খলা না থাকাকে দায়ী করেছেন অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি প্রকল্পের সঠিক সুফল জনগণের মধ্যে পৌঁছে দিতে এবং সরকারি অর্থের অপচয় কমাতে সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের তাগিদ সংশ্লিষ্টদের।
বিশ্বব্যাংক ঋণ হাতছাড়া প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সঠিক সময় ও নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রকল্প শেষ করলে অপচয় কমবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে শৃঙ্খলা না আনলে দাতা সংস্থা যদি দেখে ধীরগতি হচ্ছে তাহলে টাকা তুলে নেবে এটাই স্বাভাবিক।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রকল্প চয়েস সঠিক হতে হবে ও প্রণয়ন ঠিকমতো হতে হবে। কস্ট ও টাইম ওভাররান যেন না হয়। শৃঙ্খলা না আনলে সব দিক থেকে ক্ষতি হবে। আমরা একদিকে সঠিক বেনিফিট পাবো না, অন্যদিকে ঋণেরও সঠিক ব্যবহার হবে না।’
জানা যায়, ২০১৬ সালে উৎপাদন বাড়াতে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আধুনিকায়ন ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা ২০১৯ সালের জুনের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা। শুরুতে মূল খরচ ছিল দুই হাজার ২৯ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম দফায় ৪২ কোটি টাকা খরচ এবং সময় তিন বছর বাড়ানো হয়। তাতেও কাজ হয়নি। নতুন করে জুন ২০২২ ও পরে জুন ২০২৪ নাগাদ মেয়াদ বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যয়ও বাড়ানো হয়, তবুও শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ।
আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সঠিক সময় ও নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রকল্প শেষ করলে অপচয় কমবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে শৃঙ্খলা না আনলে দাতা সংস্থা যদি দেখে ধীরগতি হচ্ছে তাহলে টাকা তুলে নেবে এটাই স্বাভাবিক।- বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী
নতুন করে ডিসেম্বর ২০২৫ নাগাদ মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। সবশেষ ব্যয় দুই হাজার ১৭১ কোটি ৪৪ লাখ ছিল। নতুন করে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ২২৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ফলে নতুন করে সময় বাড়ানোর পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ৫৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ এক হাজার ৫৫৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা, বাকি অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে আসবে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
সমপরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে ১৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ঘোড়াশাল চতুর্থ ইউনিট পুরাতন স্টিম টারবাইনকে কম্বাইন্ড সাইকেল মোডে রূপান্তর। ৪০৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানো, বিদ্যুৎকেন্দ্রের দক্ষতা বাড়ানো ও গ্যাস টারবাইনের এক্সস্ট ফ্লু গ্যাস পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ কমানো।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম
গ্যাস টারবাইন জেনারেটিং ইউনিট, গ্যাস বুস্টার কমপ্রেশার এবং অক্সিলারিজসহ ডিজেল জেনারেটর সেট স্থাপন, হিট রিকভারি স্টিম জেনারেটর সেট স্থাপন, বর্তমান ১৯০ মেগাওয়াট স্টিম টারবাইন জেনারেটিং ইউনিটের রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড মডিফিকেশন করা।
ট্রান্সফরমার, সুইচ গিয়ার অক্সিলারি ট্রান্সফরমার ও অন্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি স্থাপন, বিদ্যমান পাওয়ার ইভাকুয়েশন সিস্টেমের (চতুর্থ ইউনিটের) সংস্কার এবং গ্যাস টারবাইনের জন্য পাওয়ার ইভাকুয়েশন সিস্টেম স্থাপন করা। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন, পরিমাপক ও নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি স্থাপন ও পূর্তকাজ করা।
প্রকল্পের বিভিন্ন খাতের ব্যয়
নতুন করে রাজস্ব খাতে ৮ কোটি ৭৮ লাখ, টার্ন-কি পার্ট খাতে ৪৬ কোটি ৪৭ লাখ, গ্যাস টারবাইনের এলটিএসএ লেং টার্ম সার্ভিস এপ্রিম্যান্ট খাতে খুচরা যন্ত্রাংশ ও কনজিউমেবলস সরবরাহে ১২ কোটি ৭২ লাখ টাকা বাড়ছে। এছাড়া ব্যাংক চার্জ ফর এলসি ওপেনিং খাতে ১৪ কোটি ৫০ লাখ, অফিস ফার্নিচার, ইক্যুপমেন্ট ইনক্লুডিং অল অ্যাক্সেসরিজ খাতে ৮ কোটি ৫ লাখ, পারমানেন্ট ম্যাটেরিয়ালস খাতে এক কোটি এবং ইন্টারেস্ট ডিউরিং কন্সট্রাকশন খাতে ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় বেড়েছে।
দ্বিতীয় সংশোধিত প্রকল্পের তুলনায় প্রস্তাবিত তৃতীয় সংশোধিত প্রকল্পে ট্রেনিং ফর ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট অব বিপিডিবি খাতে ৩ কোটি ৪২ লাখ, কান্টম ডিউটি, ট্যাক্সেস এবং ভ্যাট খাতে ২৮ কোটি ২০ লাখ, প্রাইস কন্টিনজেন্সি খাতে এক কোটি টাকা কমছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Matribhumir Khobor